শ্রী’ শব্দের অর্থ লক্ষীদেবী
শ্রী’ শব্দের অর্থ লক্ষীদেবী কৃষ্ণের শক্তি ।
এতে বোঝা যায় যে সংকীর্ত্তনের মধ্যে কৃষ্ণ তাঁর শক্তি সহিত উপাসিত হন । কারণ কৃষ্ণের শক্তি ত’ কৃষ্ণের মধ্যেই রয়েছেন ।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলছেন যে, শ্রীকৃষ্ণসংকীর্ত্তন সমগ্র বিশ্বের মধ্যে প্রসারিত হবে । কোনও বাধা না পেয়ে তা বিজয় লাভ করবে; “পরং বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণসংকীর্ত্তনম্ ।” তা হৃদয় থেকে আপনা আপনি কোন বাধা না পেয়ে স্বতঃই উচ্চারিত হবে । আরও তা ঐকান্তিক, স্বাধীন ভাবে হবে, তাতে কোনও বাধা থাকবে না । এবং কৃষ্ণের এই যে কীর্ত্তন, তা অনেকে মিলে সমবেতভাবে করবে—এই রকম কীর্ত্তনের যে vibration বা ভাবতরঙ্গ তা সমগ্র জগতেরও মঙ্গলকারক । কেবলমাত্র শরণাগতি ও শুদ্ধভক্তির দ্বারাই আমরা শ্রীকৃষ্ণসংকীর্ত্তন করতে পারি ।
চেতোদর্পণমার্জ্জনম্ঃ
কৃষ্ণনাম কীর্ত্তন করার সময় আমরা কি কি stage, অবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হই ?প্রথম অবস্থা হল এই যে, নামকীর্ত্তন আমাদের চিত্তকে নির্মল করে । আমাদের চিত্ত বা মন একটা আয়নার মত । যদি ঐ মনরূপ আয়নাতে ধূলো জমে যায়, তা হলে আমরা সব জিনিষ ভাল করে দেখতে পাই না । আর শাস্ত্রের উপদেশগুলি তাতে ঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না । মনের আয়নায় যে সব ধূলো জমে যায়, সেগুলো কি কি ?আমাদের অসংখ্য কামনা-বাসনা—যেগুলি প্রতি মুহূর্ত্তে পরিবর্ত্তন হতে থাকে এবং যোজনাবদ্ধভাবে মনকে গ্রাস করতে থাকে, সেগুলিকেই মনের ধূলো বলা হয় ।
আমাদের হৃদয় ও মনে সেই ধূলোই স্তরে স্তরে জমতে থাকে তাই আমরা কোনও জিনিষ ঠিকভাবে দেখতে পাই না । চিত্তপটে সেগুলি প্রতিফলনও ঠিকভাবে পড়তে দেয় না । জাগতিক কামনা-বাসনা আমাদের মন ও চিত্তকে এইভাবে আবৃত করে রাখে ।
ভুক্তি-মুক্তি-সিদ্ধকামী সকলি অশান্ত”
সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ-সংকীর্ত্তনের প্রথম কাজ হল—মনকে পরিষ্কার করা । বৈদিক সমাজ-ব্যবস্থা অর্থাৎ বর্ণাশ্রম ধর্মের ব্যবস্থা এই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে । আমরা যদি আমাদের সামাজিক কর্ত্তব্য ও দায়িত্ব কোনও ফলের প্রত্যাশা না করে ঠিকভাবে করতে পারি, তখন আমরা চিত্তশুদ্ধি লাভ করতে পারি । কিন্তু এও মনে রাখতে হবে—নাম-সংকীর্ত্তনের প্রথম ফলই হল বর্ণাশ্রম ধর্মের শেষ ফল—মন ও চিত্তের বিশুদ্ধি । তখনই আমরা বৈদিক উপদেশগুলি বুঝতে পারি ।
নামসংকীর্ত্তনের পরবর্ত্তী ফল হল—‘ভবমহাদাবাগ্নিনির্ব্বাপনম্’— জন্ম-মৃত্যু-চক্ররূপ সংসার-দাবানলের প্রশমন । আমরা বিভিন্ন যোনিতে নানা প্রকার দেহ নিয়ে বারবার জন্মাই ও মরি । আত্মা দেহের সঙ্গে মিশে গিয়ে এই সংসার-সাগরের তরঙ্গে নানাভাবে হাবুডাবু খেতে থাকে । নাম-সংকীর্ত্তনের প্রভাবে আমাদের আত্মা এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি পায় । এইটাই হল নাম-সংকীর্ত্তনের দ্বিতীয় ফল ।
প্রথম অবস্থায় বুদ্ধি শুধু হয়, দ্বিতীয় অবস্থায় নামপ্রভু ত্রিতাপের জ্বালা থেকে মুক্তি দান করেন । এই ত্রিতাপ হন আধ্যাত্মিক অর্থাৎ দেহ ও মনের সন্তাপ, যেমন রোগ ও মানসিক দুঃখ, উদ্বেগ; আধিভৌতিক—পারিপার্শ্বিক অবস্থায় মানুষ, পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গ এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণী থেকে প্রাপ্ত দুঃখ-যন্ত্রণা । আর আধিদৈবিক বলতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন দুর্ভিক্ষ, বন্যা, বাত্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি । আমরা এই তিন প্রকার দুঃখ ভোগ করে থাকি । তা আগুনের মত আমাদের হৃদয়কে অনবরত জ্বালা দিতে থাকে । কিন্তু নাম-সংকীর্ত্তনের দ্বিতীয় ফলেতে ঐ আগুন চিরদিনের জন্য প্রশমিত হয় এবং আমরা শান্তিলাভ করি ।
নিত্য নূতন আনন্দ-সমুদ্রের আস্বাদনের সৌভাগ্য প্রদান করেন—প্রতিপদং পূর্ণামৃতাস্বাদনম্ ।
সর্বাত্মস্নপনম্ঃ
কৃষ্ণনাম-সংকীর্ত্তনের শেষ ফল হল—সর্বাত্মস্নপনং purification of our entire existence—আমাদের সত্তার সম্পূর্ণ বিশুদ্ধি । নামকীর্ত্তনের যে আনন্দরস-সম্ভোগ, তা অপবিত্র করে না, পরিশুদ্ধ করে, পবিত্র করে । সম্ভোগ অর্থ exploitation; জাগতিক জড়সম্ভোগ একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—creates a reaction এবং সম্ভোগকারীকে অপবিত্র করে, কিন্তু এখানে যখন স্বয়ং কৃষ্ণই ভোক্তা, তখন তার ফল হল পবিত্রতা, বিশুদ্ধি । কেন্দ্র থেকে যা কিছু সম্ভোগ আসে, কৃষ্ণের স্বতন্ত্র ইচ্ছায় যা কিছু আসে, সেসবই আমাদিগকে পবিত্র করেন, শুদ্ধ করেন ।
এই শ্লোকে সর্বাত্মস্নপনং শব্দের অর্থই হচ্ছে এই যে, আত্মার যাবতীয় বিভাব পরিপূর্ণরূপে সন্তোষ, পবিত্রতা ও বিশুদ্ধি কৃষ্ণনাম কীর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তৎক্ষণাৎ লাভ হয়ে থাকে । আর সর্বাত্মস্নপনের আর একটা অর্থও আছে । আমরা যদি অনেকে মিলে নামসংকীর্ত্তন করি—কৃষ্ণের রূপ-গুণ-যশ ও লীলার কীর্ত্তন করি, তখন আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী বিশুদ্ধি লাভ করতে পারি । কীর্ত্তনকারী ও শ্রবণকারী উভয়ে এমন কি সেই চিন্ময় শব্দ ব্রহ্মের সম্পর্কে যে কোন প্রাণী এলে সেও পবিত্র হয়ে যায় । ‘স্নপনং’ মানে পবিত্র হওয়া, শুদ্ধ হওয়া । ঐ শব্দতরঙ্গ প্রত্যেক প্রাণীকে, প্রত্যেক বস্তুকেও স্পর্শ মাত্রেই পবিত্র করে ।
তাই শ্রীমন্মহাপ্রভু বলেন, সকলে মিলে একত্র হয়ে কৃষ্ণনাম সংকীর্ত্তন করতে থাক । কিন্তু সেই সংকীর্ত্তন সত্যি সত্যি হওয়া চাই । তাই সাধুসঙ্গ দরকার—
সাধুসঙ্গে কৃষ্ণনাম এইমাত্র চাই ।
সংসার জিনিতে আর কোন বস্তু নাই ॥
এটা একটা মানসিক কসরৎ মাত্র নয় । আমরা তো উপরের অকুণ্ঠ ধামের সঙ্গে connection করার চেষ্টা করছি, যিনি কৃপা করে আমাদের সাহায্যের জন্য নেমে আসবেন । আমরা higher reality-র সঙ্গেই connection চাই, কারণ সেইটাই ত সব থেকে জরুরী । কৃষ্ণের দিব্য নাম ত একটা সাধারণ শব্দ মাত্র নয়—কেবল ঠোঁট নাড়ান মাত্র নয়; তাঁর ত’ একটা greater and higher aspect আছে—‘নামাক্ষর বাহিরায় বটে তবু নাম কভু নয়’ । এর ত সবটাই spiritual—পরজগতের ব্যাপার । আমরা একটা marginal plane—তটস্থ অবস্থায় আছি । তাই higher connection নিশ্চয়ই দরকার, যাতে পরজগৎ থেকে কৃপার wave নেমে আসবে—আমাদের ভেতর বাহির সবটার উপর প্রভাব বিস্তার করবে ।
যেখানেই হোক না কেন, কৃষ্ণসংকীর্ত্তন এই সাত প্রকার ফল দেবেই । শিক্ষাষ্টকের প্রথম শ্লোকের এইটিই হল সারমর্ম । প্রথম effect হল—কৃষ্ণনাম সংকীর্ত্তন প্রথমে সংসারের কামনা-বাসনা রূপ যে ময়লাগুলো আত্মাকে আচ্ছাদন করেছে, সেই ময়লাগুলোকে ঝেড়ে পরিষ্কার করে । দ্বিতীয়তঃ তা মুক্তিদান করে । তৃতীয় কাজই প্রকৃত সৌভাগ্য এনে দেয় । তা হল আত্মসম্পদের দ্বার খুলে দেওয়া । কৃষ্ণনামকীর্ত্তন আত্মার অন্তর্নিহিত ভাবসম্পত্তিকে ক্রমে ক্রমে জাগিয়ে তোলে । এইখানেই শ্রীমন্ মহাপ্রভু পরতত্ত্বের সঙ্গে অন্যান্য সম্পর্ক সূত্রগুলির প্রসঙ্গ এনেছেন । পরবর্ত্তী সোপানের কথা বলতে গিয়ে তিনি মধুরসের প্রেমভক্তির সূচনা দিয়েছেন, যাতে সাধক কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেম সেবার জন্য অহেতুকভাবে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেম সেবার জন্য অহেতুকভাবে নিজের সর্বস্ব সমর্পণ করে দেয়
No comments