কৃষ্ণসঙ্গের আনন্দঃকৃষ্ণের ব্রজধামে যাঁরা ঠিকভাবে কৃষ্ণনাম করতে পারে
কৃষ্ণসঙ্গের আনন্দঃকৃষ্ণের ব্রজধামে যাঁরা ঠিকভাবে কৃষ্ণনাম করতে পারে।
পরবর্ত্তী সোপান হল—কৃষ্ণসঙ্গরসামৃতের আস্বাদন । কৃষ্ণের ব্রজধামে যাঁরা ঠিকভাবে কৃষ্ণনাম করতে পারে, তাঁদের একপ্রকার অদ্ভূত স্বাভিমান জেগে উঠে,—
তুণ্ডে তাণ্ডবিনীরতিং বিতনুতে তুণ্ডাবলীলব্ধয়ে
কর্ণক্রোড়কড়ম্বিনী ঘটয়তে কর্ণার্বুদেভ্যঃ স্পৃহাম্ ।
চেতঃপ্রাঙ্গণসঙ্গিনী বিজয়তে সর্বেন্দ্রিয়াণাং কৃতিং
নো জানে জনিতা কিয়দ্ভিরমৃতৈঃ কৃষ্ণেতি বর্ণদ্বয়ী॥
(বিদগ্ধ মাধব ১।১২)
যখন কৃষ্ণনাম ভক্তের মুখে আবির্ভূত হয়, তখন সে পাগল হয়ে নাচতে থাকে । তার পরে, কৃষ্ণনাম এমন প্রভাব বিস্তার করে যাতে ঐ ভক্ত নিজের মুখের উপর সমস্ত কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে । তখন সে বলতে থাকে—কেবল একটা মুখে কতইবা কৃষ্ণনাম রস আস্বাদন করব, কৃষ্ণ নামের মাধুর্য্য আস্বাদন করতে আমার লক্ষ মুখের প্রয়োজন । একটা মাত্র মুখে কৃষ্ণ নাম বলে আমার আদৌ তৃপ্তি হয় না ।
শ্রীকৃষ্ণনাম যখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, তখনই হৃদয়ে নামের অপ্রাকৃতত্ব অনুভূত হয়—“কেবল দুটো কান কেন ? বিধির এ কি অবিচার!! আমারত লক্ষ কান দরকার!তাতে হয়ত মনে একটু তৃপ্তি পেতাম—আমি ত’ লক্ষ লক্ষ কান চাই কৃষ্ণ নাম শুনবার জন্য!” কৃষ্ণ নামের দিকে মন গেলে ভক্তের মনের অবস্থা এই রকমই হয়! তারপরে সে মূর্চ্ছিত হয়ে যায়; প্রেমানন্দ সাগরে হাবুডুবু খেয়ে সে নিজেকে একেবারেই হারিয়ে ফেলে । হতাশ হয়ে আবার বলে, কৃষ্ণনামের মহিমা, তার মাধুর্য্য—কিছুইত’ বুঝতে পারছি না, হায় আমি কি করি ?? এ নামে কত মাধুর্য্য আছে ???
“না জানি কতেক মধু শ্যামনামে আছে গো”
—এইভাবেই নামকীর্তনকারী বিহ্বল হয়ে যায় ।
কৃষ্ণের বেণুমাধুর্য্যঃ
মাধুর্য্যের চরম প্রকাশ কৃষ্ণের নাম, তা ঠিকভাবে কীর্তন কর, এইটিই শ্রীমন্ মহাপ্রভুর শিক্ষা-উপদেশ । সেই মাধুর্য্য কৃষ্ণের বংশীধ্বনিতেও আছে । কৃষ্ণের বংশীধ্বনির অদ্ভুত প্রভাব । সৃষ্টির যাবতীয় বস্তু ও যাবতীয় প্রাণীকে আকর্ষণ ও বশীভূত করার বিস্ময়কর ক্ষমতা এই বংশীধ্বনির রয়েছে । কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে যমুনার জলের প্রবাহ স্থির হয়ে যায়, উজান বয়ে যায়, বৃক্ষ-লতা, পশু-পক্ষী সকলকেই এই বংশী আকর্ষণ করে । এই বংশী গানের তরঙ্গ সব কিছুকেই স্তব্ধ করে দেয়, বিভ্রান্ত করে দেয় ।
শব্দতরঙ্গ অসাধ্য সাধন করে । শব্দের ধরে রাখার ক্ষমতা অসীম । শব্দ সারতেও পারে, তারতেও পারে । তার যা ইচ্ছা করতে পারে । এর এমনই অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে । Ether এর নাগালের বাইরের ঊর্দ্ধস্তরের অতি সূক্ষ্মতম স্তর থেকে তা নেমে আসে । সেই সর্ব ব্যাপক শব্দশক্তিই যাবতীয় কল্যাণ ও মাধুর্য্যের আকর । সেই শব্দের—কৃষ্ণনামের কত শক্তি ?? আমাদের কেমন করে আকর্ষণ করে ?? এক টুকরো ঘাস যেমন বাতাসে যেদিকে ইচ্ছা যেতে থাকে—তেমনই নামরূপী শব্দরূপী শব্দব্রহ্ম আমাদিগকে এমন করে চালায় যে, আমরা নিজের সত্তাও খুঁজে পাই না । আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলি, কিন্তু মরে যাই না । কারণ আমরাও শাশ্বত । সেই শব্দতরঙ্গে আমরা কেবল উপর নীচু হয়ে হাবুডুবু খাই । একটা তৃণের চেয়েও আমরা অধম, আর কৃষ্ণ নামের শব্দ এত বড় এত মধুর যে তা আমাদিগকে নিজ ইচ্ছামত যেমন ইচ্ছা চালায় । কৃষ্ণনামের কত শক্তি তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না । চরম কল্যাণ ও মাধুর্য্যের আকর কৃষ্ণনাম এতই শক্তি ধরে। শ্রীমন্মহাপ্রভু বলছেন, যে নাম নামী হতে অভিন্ন, সেই নামকে অবহেলা কর না । তা অশেষ কল্যাণও মাধুর্য্যের খনি, নামের মধ্যে সবই আছে । আর সেই নাম আমাদের কাছে খুবই সস্তায় ধরা দিয়েছে । তাঁকে ক্রয় করতে কিছুই মূল্য দিতে হয় না, কোন শারীরিক শক্তির দরকারও হয় না । এ সব নামের কাছে অনাবশ্যক । কেবল দরকার নিষ্ঠা—Sincerity ।
যে সাধক নিষ্ঠাযুক্ত হয়ে এই নামকে আশ্রয় করে, সে এতই ধনী হয়ে যায় যে, কেহ কল্পনাও করতে পারে না—সে কত বড় ভাগ্যবান্, কত উন্নত!! আর যে কেহ তা খুবই সস্তায় পেতে পারে, কেবল নিষ্ঠাযুক্ত হয়ে সমগ্র হৃদয় দিয়ে, নামকীর্তন করা চাই—কেবল এইটুকুই দরকার । অবশ্য উপযুক্ত সাধু-গুরুর নিকটই সেই নাম গ্রহণ করা দরকার ।
শ্রীকৃষ্ণনাম সংকীর্ত্তন আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রথম প্রবক্তাই হচ্ছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি স্বয়ং শ্রীরাধা-গোবিন্দ মিলিততনু । তাঁর উপদেশ হচ্ছে—এই সর্ব কল্যাণপ্রদ ও চিত্তশুদ্ধিকারক শ্রীকৃষ্ণনাম সংকীর্ত্তনকে আন্তরিক নিষ্ঠা ও নৈরন্তর্য্যসহ আশ্রয় কর—যে নাম আমাদের মুক্তি দান করবে, যাবতীয় বাসনার নিবৃত্তি করবে এবং এমন সার্থকতা এনে দেবে যা দ্বারা আমরা সেই অপ্রাকৃত মাধুর্য্য রসসাগরে নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণ নিমজ্জন করতে পারব ।
এইটিই শ্রীমন্মহাপ্রভুর সর্বোত্তম কৃপা । আর তিনি বলেন, শ্রীকৃষ্ণনাম সংকীর্ত্তন সমগ্র জগতে প্রসারিত হোক যাতে করে সমগ্র জীবজগৎ সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণ লাভ করে ধন্য হবে । কারণ এর দ্বারাই যাবতীয় দুঃখের নিবৃত্তি হবে, আর এইটিই জীবের চরম সার্থকতা ।
এই কলিযুগে কেবল নামসংকীর্ত্তনই আমাদের সাহায্য করতে পারে । নাম সংকীর্ত্তন সব যুগের জন্যই কল্যাণপদ । তা হলেও কলিযুগের জন্য নামসংকীর্ত্তনের উপযোগিতা সবচেয়ে বেশী । তার কারণ এই যুগে অন্য সব সাধন ব্যবস্থায় বাধা অনেক বেশী, কিন্তু জগতের কোন বাধাই নামসংকীর্ত্তনের প্রভাবকে ব্যাহত করতে পারে না । অতএব নামসংকীর্ত্তনই কলিযুগের একমাত্র সাধন । যদি আমরা ঐকান্তিক বিশ্বাস ও ভরসা নিয়ে এই নামসংকীর্ত্তন পন্থাকেই আশ্রয় করি, তবে আমাদের জীবনের সব কিছুই পাওয়া হয়ে যাবে । অন্য কোন সাধনপন্থা গ্রহণের প্রয়োজন নাই; কারণ সে সবই ত্রুটিপূর্ণ ও আংশিক ফল প্রদান করে । কিন্তু নামসংকীর্ত্তন জগতের সকলের জন্য সর্বাপেক্ষা সহজ অথচ সর্ব্বোচ্চ ফল প্রদান করে । এর দ্বারা সকলেই পরম শান্তি লাভ করতে পারে ।
যে সব জীবাত্মা, এখন কৃষ্ণ সম্বন্ধ জ্ঞান থেকে বিচ্যুত হয়ে আছে, তাদের সকলেরই এই নাম সংকীর্ত্তন দ্বারা চরম কল্যাণ লাভ হবে । অন্য কোন প্রকার আন্দোলনের দরকারই নাই । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন, তোমরা সর্বতোভাবে এই নামকীর্ত্তনকেই আশ্রয় কর । এতেই সর্বসিদ্ধি লাভ হবে । আর তোমরা সামান্য পরিশ্রমে অনায়াসে তা লাভ করবে । কলিযুগে নামসংকীর্ত্তনেরই জয় হোক । এর দ্বারাই সারা বিশ্বের কল্যাণ হবে । সারা জীবজগৎ এর দ্বারাই স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত হবে । শ্রীমদ্ ভাগবতে উপসংহারে শেষ শ্লোকে বলা হয়েছে—
নামসংকীর্তনং যস্য সর্বপাপপ্রণাশনম্ ।
প্রণামো দুঃখশমনস্তং নমামি হরিং পরম্ ॥
পাপ বলতে সকল অনর্থ সকল অবাঞ্ছিত বস্তু, অপরাধ । জাগতিক সুখসম্ভোগ আর মুক্তি এ দুটোই অনর্থ, পাপ মধ্যে গণ্য । মুক্তিকেও পাপ ব’লে কেন বলা হয়েছে ?কারণ সেও একটা অস্বাভাবিক অবস্থা । আমাদের স্বাভাবিক নৈসর্গিক কাজ হল কৃষ্ণসেবা । মুক্তিতে ত’ আমরা সেবা করতে পারি না । কেবল মুক্তিটাই ত’ সেবা নয় । তাই মুক্তিটাও অস্বাভাবিক বলে পাপ । আমাদের স্বাভাবিক কাজ বাদ দিয়ে তা থেকে দূরে থাকাই ত’ পাপ।
No comments