Header Ads

হিন্দুত্ববাদ কি? হিন্দু, হিন্দুত্ব, হিন্দুস্তান

হিন্দুত্ববাদ কি?  হিন্দু, হিন্দুত্ব, হিন্দুস্তান 



হিন্দুহিন্দুত্বহিন্দুস্তান 

সৌম্য মুখোপাধ্যায় 

[]

বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মগুলির অন্যতম হল সনাতন ধর্ম। এই সনাতন ধর্ম কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিতি পেয়েছে এবং সুদীর্ঘকাল ধরে আমাদের উপমহাদেশে নানান ছন্দ ও ধারায় বিকশিত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রকাশ ভঙ্গি রূপে একটি রাজনৈতিক ভাষ্য — ‘হিন্দুত্ব’-কে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেতে দেখা যাচ্ছে, যার সঙ্গে ‘হিন্দু’ শব্দবন্ধের শব্দগত সাযুজ্য রয়েছে। এই হিন্দুত্বকে এককথায় হিন্দু রাজনৈতিক দর্শন  বা হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দু সংস্কৃতিবাদ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। হিন্দুত্ব শব্দটির উদ্গাতা রূপে চন্দ্রনাথ বসুর নাম স্মরণীয়। তিনি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘হিন্দুত্ব — হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস’ গ্রন্থে হিন্দুত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এক গোঁড়া, ঐতিহ্যবাহী  জীবন-দর্শনের রূপরেখা প্রদান করেন। অবশ্য এই হিন্দুত্বের ভাষ্যের কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল না। 

রাজনৈতিক হিন্দুত্ব-এর উদ্ভব কাল রূপে মোটামুটি ভাবে ১৯২০-র দশকের সূচনাপর্বকে ধরা হয়। এই সময়ই বিনায়ক দামোদর সাভারকার তাঁর ‘Essentials of Hindutva’ প্রকাশ করেন। একই সময়, ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। এই সাংস্কৃতিক সংস্থাটি হিন্দুত্বকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং বহু মানুষকে তার দ্বারা প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়েছে।  এর অনেক পরে ২০১৪ এবং ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে বিজেপির ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি ভারতীয় রাজনীতির অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে। এরই সূত্র ধরে হিন্দুত্ব নিয়ে বিস্তর আলোচনা পণ্ডিত মহলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই আলোচনার একদিকে যেমন রয়েছে সাভারকারের হিন্দুত্বের ধারণার ওপর টিপ্পনী, তেমনি রয়েছে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে হিন্দুত্বের পার্থক্য এবং হিন্দুত্ব কতখানি হিন্দু ধর্ম অনুসারী সেই সংক্রান্ত বিতর্ক। এই আলোচনগুলিকে অনুসরণ করেই বর্তমান নিবন্ধে আমরা হিন্দুত্বের পরিচিতিকে বোঝার চেষ্টা করব। 


[]

হিন্দুত্বের ধারণার গোড়ায় রয়েছে ‘হিন্দু’ শব্দটি, যা কিনা পুরোপুরি একটি নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক সত্তার দ্যোতক। প্রাচীন গ্রিকরা ভারত ভূখণ্ডকে চিহ্নিত করেছিল ‘ইন্ডিকা’ নামে। বলা বাহুল্য, এই ইন্ডিকার উৎস হল ইন্ডাস বা সিন্ধু নদী। একারণেই মেগাস্থিনিস ও এরিয়ান তাঁদের ভারত উপমহাদেশের ওপর বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘ইন্ডিকা’। পারসিকরাও ভারত ভূখণ্ডকে বোঝাতে সিন্ধু নদীর পরিচিতিকেই আশ্রয়  করেছিল। তবে পারসিক ভাষায় ‘স’ ধ্বনিটি ‘হ’ রূপে উচ্চারিত হওয়ায় তাদের পরিভাষায় সিন্ধু নদের ওপারের ভূখণ্ডটি  হিন্দু নামে প্রচারিত হয়। শুধু বিদেশেই নয়, প্রাচীন ভারতে উদ্ভূত বৈদিক বা বৌদ্ধ শাস্ত্রেও হিন্দু শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায় না। ভারতীয় সনাতন ধর্মের বিভিন্ন দার্শনিক শাখাগুলিও নিজেদের পরিচয় দিতে হিন্দু শব্দের পরিবর্তে বৈষ্ণব, শাক্ত, মহাযান, বজ্রযান, অদ্বৈত ইত্যাদি ব্যবহার করেছিল। স্বয়ং আদি শংকরাচার্য যিনি অষ্টম শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্লাবনের মুখে ‘হিন্দু ধর্ম’-কে রক্ষা করেছিলেন তাঁর শব্দ ভান্ডারেও হিন্দু শব্দটি ছিল না। তিনি অদ্বৈতবাদের প্রচার করেন। সুতরাং প্রাচীন ভারতে হিন্দু শব্দটি একটি নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক পরিচিতি রূপে প্রকাশ পেয়েছে যার সঙ্গে কোনও ধর্মেরই সম্পর্ক নেই। 

এমনকি মধ্যযুগের সূচনায় হিন্দু বলতে এক বিশেষ জনগোষ্ঠীকেই ইঙ্গিত করা হয়েছিল। অষ্টম শতকের পারসিক গ্রন্থ ‘চাচনামা’-তে ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে ‘হিন্দোয়াঁ’ ও ‘হিন্দাবি’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। ১১৯২-এর পরবর্তী সময়ে চাঁদ বরদাই-এর ‘পৃথ্বীরাজ রসো’ গ্রন্থে পৃথ্বীরাজ চৌহান ও মোহাম্মদ ঘোরির যুদ্ধকে হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ রূপে বর্ণনা করা হয়নি, বরং  হিন্দু-তুর্কি যুদ্ধ রূপে সাব্যস্ত করা হয়। আল বিরুনির ‘তারিক আল হিন্দ’ বা সুলতানি যুগের অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থগুলিতেও যে হিন্দু শব্দের রেফারেন্স এসেছে সেখানে হিন্দু বলতে ভারতের অনৈস্লামিক জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করা হয়েছে, বিশেষ কোনও ধর্ম গোষ্ঠীকে নয়। তবে পরবর্তী মধ্যযুগে ভারতীয় সাহিত্যে হিন্দু শব্দের ব্যবহার  লক্ষ করা যায়। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যে দেশীয় জনগোষ্ঠীকে হিন্দু নামে অভিহিত করা হয়েছে যবন বা বিদেশিদের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক পার্থক্যের খাতিরে। এখানে ধর্মীয় পরিচয়ের আংশিক প্রসঙ্গ থাকলেও শব্দের মূল তাৎপর্য নিহিত ছিল তার নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনায়। এখানে হিন্দু কোনও একমাত্রিক ধর্মীয় পরিচয় নয় বরং দেশীয় জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক অনুশীলনের এক জটিল ধারা। 

সুতরাং, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অভিঘাতের পূর্বে দেশীয় জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে পশ্চিমের ধর্মীয় পরিচয়কে একাত্ম করা যায় না। ধর্মের পশ্চিমি ধারণায় যেখানে একজন ইহুদি, একজন খ্রিস্টান এবং একজন মুসলমান একই ঈশ্বরের উপাসনা করা সত্ত্বেও পৃথক ধর্মের সদস্য রূপে বিবেচিত হন, সেখানে ধর্মীয় জীবনের ভারতীয় ধারণায় একজন ভারতীয় একই সঙ্গে হতে পারেন একাধিক ঐতিহ্যের সদস্য। পাশ্চাত্যে প্রচলিত ধর্মের ধারণাটি একক ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে আবদ্ধ থাকলেও ভারতে দ্বৈত বা একাধিক পরিচয় ছিল সহজাত। একটি উদাহরণ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, একজন আধুনিক নেপালি একই সঙ্গে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের অনুসারী বলে নিজেকে দাবি করেন। এর প্রধান কারণ তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ এক্তিয়ারের বাইরে ছিলেন। প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতীয়দেরও এই বহুমাত্রিক ধর্মীয় পরিচয় ছিল, যা কিনা ব্রিটিশ শাসনে আদমশুমারির অভিঘাতে ভেঙে যায়। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে সূচিত আদমশুমারির সমীক্ষায় একজন ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের পরিচয়কে ঘোষণা করতে হয়েছিল। স্বভাবতই ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয়ের সংকোচন ঘটল। সেই সঙ্গে সীমিত হল হিন্দু শব্দের অর্থগত দ্যোতনা, আড়ালে চলে গেল শব্দের সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক তাৎপর্য। 


]

হিন্দু শব্দের অর্থগত সংকোচনের সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষিত ভারতবাসীর একাংশ এই প্রবণতার আদর্শগত বিরোধিতার পথকেই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁরা পাশ্চাত্যের আদলে ধর্ম ও সংস্কৃতির বিভাজন রেখা টানতে উদ্যত হন। এরই ফলস্বরূপ ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটিকে প্রস্তুত করা হয় যা কিনা এক বিশেষ সংস্কৃতিকে নির্দেশ করতে চেয়েছিল। তাঁরা হিন্দু ধর্মের বৃহত্তর পরিসর থেকে হিন্দু সংস্কৃতিকে বের করে এনে এক জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির রূপরেখা প্রদানে সচেষ্ট হলেন। মনে রাখা দরকার, ইতিমধ্যে তুরস্কের খলিফা পদের অবলুপ্তির প্রশ্নে ভারতে খিলাফত আন্দোলনের পটভূমি প্রস্তুত হয়েছিল। ভারত থেকে বহু দূরের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় মুসলমান সমাজের আন্দোলিত হওয়া এবং সেই আন্দোলনের সঙ্গে গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলন যুক্ত হয়ে পড়ার অভিঘাত হিন্দুত্বের বিকাশকে ত্বরান্বিত করল। 

এই পটভূমিতেই আমরা সাভারকারের হিন্দুত্বকে উপস্থাপন করব। সাভারকার ‘হিন্দু কে?’ — তা বোঝাতে গিয়ে তিনটি পরস্পর সম্পৃক্ত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর মতে একজন ব্যক্তির হিন্দু হওয়ার প্রথম যোগ্যতাটি হল তাঁকে তাঁর নিজের বা তাঁর পূর্বপুরুষের দৌলতে এই সমুদ্র, নদী, পাহাড় বেষ্টিত ভারতভূমি বা হিন্দুস্তানের বাসিন্দা হতে হবে। সাভারকারের মতে এই প্রথম যোগ্যতার বলে একজন আমেরিকানও এদেশে বসবাস করার সুবাদে হিন্দুদের সহ নাগরিক হতে পারেন, কিন্তু কখনোই তিনি প্রকৃত হিন্দু হতে পারেন না যতক্ষণ না তিনি হিন্দু হওয়ার অন্যান্য শর্তগুলি পূরণ করছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে, হিন্দুত্ব কেবলই একটি ভৌগোলিক  সত্তা নয়, আরো বেশি কিছু। 

এরপর, সাভারকার ‘হিন্দু’ হবার দ্বিতীয় যোগ্যতাটি তুলে ধরলেন। তাঁর মতে এটি হল একটি ‘সাধারণ রক্ত’ বা জাতিগত বন্ধন। তাঁর মতে, হিন্দু তিনিই, যিনি তাঁর বৈদিক পিতা বা সিন্ধু পিতার রক্তকে তাঁর ধমনীতে বহন করে চলেছেন। সাভারকার স্বীকার করেছেন, এটি অবশ্যই একটি আবেগঘন যুক্তি, কিন্তু হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে তাঁরা প্রত্যেকেই এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ এবং তাঁরা সকলেই এক জাতিভুক্ত। অনন্ত কাল ধরে যে রক্ত রাম ও কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও মহাবীর, নানক ও চৈতন্য, বাসব ও মাধব, রুইদাস ও থিরুভাল্লুভার-এর শরীরে প্রবাহিত হয়েছে, তারই উত্তরাধিকারী হল হিন্দুরা। 

সর্বোপরি, সাভারকার ‘হিন্দু’ হওয়ার তৃতীয় যোগ্যতা রূপে রাষ্ট্র ও জাতির প্রতি ব্যক্তির অখণ্ড ভালোবাসাকে উল্লেখ করেছেন। বিষয়টিকে সহজ করে বোঝাতে তিনি হিন্দু সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি আনুগত্যের উল্লেখ করেছেন। তাঁর কাছে হিন্দু সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূর্ত প্রতীক হল সংস্কৃত ভাষা। সাভারকারের মতে, সংস্কৃত হল সেই ভাষা যা হিন্দুদের ইতিহাসের আনাচে-কানাচে যত রত্নসম্ভার রয়েছে তা প্রকাশ ও সংরক্ষণ করতে সমর্থ। এই সংস্কৃত ভাষার মধ্যেই রয়েছে হিন্দুদের প্রাচীন ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্পকলা, আইন, উৎসব, আচার-আচরণ এবং নায়কদের কীর্তিসমূহ। এই সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে আত্মীকরণ করা হিন্দু হওয়ার সর্বশেষ মানদণ্ড রূপে সাভারকার ঘোষণা করেন। 


[]

সাভারকার প্রদত্ত হিন্দু হওয়ার উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করলে কিছু আকর্ষণীয় বিষয় উঠে আসে যেগুলি তাঁর ভাষ্যকে রাজনৈতিক করে তুলতে সাহায্য করেছে। যেমন, তাঁর ঘোষিত প্রথম দুটি বৈশিষ্ট্যের নিরিখে জৈন, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তর হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ফেলা যায়। কারণ এই ধর্ম গুলির উদ্ভব হয়েছিল এদেশেই। ফলত, এই তিনটি ধর্মের অনুগামীদের কাছে ভারত কেবল পিতৃভূমিই নয়, এটি তাদের পবিত্র ভূমিও বটে। সাভারকার-পরবর্তী হিন্দুত্ববাদীরাও এই তিনটি ধর্মকে ‘ইন্ডিক’ ধর্ম রূপে মান্যতা দেন। যাইহোক, এই প্রথম দুটি বৈশিষ্ট্যের দৌলতে ভারতের মুসলমান নাগরিকেরাও বৃহত্তর ভাবে হিন্দু রূপে গণ্য  হতে পারতেন এবং এই সম্ভাবনা সাভারকারের তত্ত্বে ছিল। এছাড়া, ভারতে বসবাসকারী মুসলিম বোহরা বা গুজরাটের খোজা সম্প্রদায় তাদের প্রাত্যহিক জীবনে সংস্কৃত সভ্যতাকে অনুসরণ করায় তাঁরাও হিন্দু পদবাচ্য হতে পারতেন। কিন্তু সাভারকার তাঁর তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের সুবাদে এই সম্ভাবনাকে নিজেই নির্মূল করেন। ভারতের ওপর পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমির বৈশিষ্ট্য আরোপ করে সাভারকার সচেতনভাবে দেশের মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে বৃহত্তর হিন্দু সম্প্রদায়ের বাইরে নিয়ে যান। এর পিছনে যুক্তি হল এই সম্প্রদায়গুলির পুণ্যভূমি ভারতে নয় বরং সুদূর আরব বা প্যালেস্তাইনে। 

আবার সাভারকার তাঁর এই তত্ত্বের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্বকে ভারতীয় জাতিসত্তার ওপরে স্থাপন করলেন। এর ফল হল এই যে, হিন্দুত্বের পূর্বশর্ত ব্যতীত কোনও ব্যক্তি তাঁর ভারতীয় জাতিসত্তাকে প্রমাণ করতে পারবেন না। অতএব, মুসলমান ও খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরা এদেশে বহিরাগত বলে গণ্য হবেন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে তাঁদের হিন্দুত্বের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। বলা বাহুল্য, সাভারকারের এই রাজনৈতিক তত্ত্ব মূলস্রোতের ভারতীয় রাজনীতির বিপক্ষে ও সমান্তরালে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এজন্যই তিনি কংগ্রেস দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য হিন্দু যুবসম্প্রদায়কে সতর্ক করলেন, সেই সঙ্গে কংগ্রেসকে বয়কটের ডাকও দিলেন। এই সময়ে সাভারকার এক বক্তৃতায় বললেন, “একখণ্ড জমি যার নাম ভারতবর্ষ, তার সামান্য ভৌগোলিক স্বাধীনতার সঙ্গে কখনোই প্রকৃত ‘স্বরাজ্য’-কে মিলিয়ে ফেলা যথার্থ নয়। হিন্দুদের কাছে হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা কেবলমাত্র তখনই মূল্যবান হয়ে উঠবে যেখানে ‘তাঁদের হিন্দুত্ব’ — তাঁদের ধর্মীয়, জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নিশ্চয়তা থাকবে। হিন্দুদের কাছে স্বরাজ্যের প্রকৃত অর্থ অবশ্যই সেই রাজ্য, যেখানে তাঁদের সত্য — তাঁদের হিন্দুত্ব নিজেদের অধিকার বলে কায়েম রাখা যাবে; অ-হিন্দু জনগণ, তাঁরা ভারতীয় ভূখণ্ডের বাসিন্দা হোন বা না হোন তাঁদের বাড়তি চাপ সহ্য করতে হবে না।”




[]

সাভারকারের রাজনৈতিক তত্ত্বকে পুরোপুরি আত্মস্থ করেছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের দ্বারাই এই তত্ত্বটি উজ্জীবিত হয়। প্রথম সংঘ প্রধান কে বি হেডগেওয়ার হিন্দুত্বকেই রাষ্ট্রবাদ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সংঘের দ্বিতীয় সভাপতি এম এস গোলওয়ালকারেরও হিন্দুত্ব ও সাভারকারের প্রতি অদ্ভুত মুগ্ধতা ছিল, যা প্রকাশ পায় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে মুম্বাইতে তাঁর বক্তৃতায়।  তিনি জানালেন যে, সাভারকারের মহান রচনা ‘হিন্দুত্ব’-এর মধ্যে তিনি জাতীয়তাবাদী নীতিসমূহের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেখতে পেয়েছেন। বস্তুত, গোলওয়ালকারের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর We or Our Nationhood Defined এবং Bunch of Thoughts গ্রন্থগুলিতে। 

আধুনিক সময়ে স্বীকৃত ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের তীব্র নিন্দা করেছিলেন গোলওয়ালকার। তিনি লেখেন, “এখানে ইতিমধ্যেই হিন্দুদের একটি পূর্ণ বিকশিত প্রাচীন রাষ্ট্র ছিল। অন্যান্য যেসব গোষ্ঠী এই দেশে বাস করছে, তারা তখন হয় ইহুদি, পার্শিদের মতো অতিথি হয়ে এসেছিল কিংবা মুসলিম, খ্রিস্টানদের  মতো আক্রমণকারী ছিল। তারা সকলেই এখন এক সাধারণ শত্রুর শাসনাধীনে একটি সাধারণ আঞ্চলিক সীমার মধ্যে বাস করে — এ এক দুর্ঘটনা। কেবলমাত্র এই একটি কারণেই এই সব বিভিন্ন গোষ্ঠী সমূহকে কেমন করে একই মাটির সন্তান বলা যাবে, সে প্রশ্নের মুখোমুখি হবার সময় হয়েছে … যে ভৌগোলিক  জাতীয়তাবাদ এবং সাধারণ বিপদের তত্ত্বে আজ আমাদের রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে উঠেছে, তাতে আমাদের প্রকৃত হিন্দু জাতীয়তাবাদকে যথার্থ এবং উৎসাহব্যঞ্জক বিষয়বস্তু থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, আর স্বাধীনতা আন্দোলন প্রকৃত পক্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত হচ্ছে। দেশাত্মবোধ এবং জাতীয়তাবোধের সঙ্গে ব্রিটিশ-বিরোধিতা সমার্থক হয়ে পড়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষ প্রত্যেকের ওপর এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গির একটা ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে।” সংঘের ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের দলিল এই রচনাটির ওপর নির্ভরশীল। 

সাম্প্রতিককালে, সংঘ প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্যেও হিন্দুত্বের সর্বব্যাপী রূপটি ধরা পড়েছে। তাঁর মতে, হিন্দুত্ব সকল ভারতীয়দের জন্য একটি সাধারণ বিভাজক এবং শুধুমাত্র একটি জাতি, গোষ্ঠী বা পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুলাই মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে, হিন্দুত্ব  আমাদের আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা এবং ভারতবর্ষের মূল্যবোধের সামগ্রিকতার সঙ্গে আমাদের পরিচয়কে একাত্ম করার শব্দ। … ‘হিন্দু’ কোনও সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠীর নাম নয়, এটি একটি ভৌগোলিক ধারণা নয়, এটি কোনও একক জাতির, বংশের বা নির্দিষ্ট ভাষাভাষীদের বিশেষাধিকারও নয়। বস্তুত মোহন ভাগবত হিন্দুত্বকে ভারত রাষ্ট্রের স্বতঃস্ফূর্ত চেতনা বলে মনে করেছেন। তিনি হিন্দুদের যে-কোনও মূল্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দিচ্ছেন। “এক জায়গায় সব হিন্দুকে জল খেতে হবে। একই ধর্মস্থলে তাঁদের প্রার্থনা করা উচিত। এমনকি মৃত্যুর পর একই জায়গায় সকলের শেষকৃত্য হওয়া উচিত।” 


[]

হিন্দুত্ববাদীদের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, হিন্দুত্ব হিন্দু ধর্মের কোনও শাখা নয়, বরং এক স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিশ্বাস। হিন্দুত্ববাদের সমালোচকেরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে একে সমালোচনা করেছেন। যেমন, শশী থারুর তাঁর ‘The Hindu Way — An Introduction To Hinduism’  গ্রন্থে জানাচ্ছেন, “এটি (হিন্দুত্ব) হিন্দুধর্মকে এমন কিছু হিসাবে নতুন করে সাজাতে চায় যা কখনও ছিল না … হিন্দুত্ব প্রকল্পটি একটি নতুন বিশ্বাস কাঠামো এবং একটি নতুন শব্দ ভান্ডার দিয়ে হিন্দু পরিচয়কে নতুন করে গড়ে তুলতে চায়।” তাঁর মতে, হিন্দু ধর্ম, যা কিনা  বিস্ময়কর বিস্তার এবং বিস্ময়কর সহনশীলতার ধর্ম রূপে পরিচিত, তার এক চূড়ান্ত বিকৃতি হল হিন্দুত্ব। “Hinduism, with its openness, its respect for variety, its acceptance of all other faiths, is one religion which has always been able to assert itself without threatening others. But this is not the Hindutva that destroyed the Babri Masjid, nor that spewed in hate-filled diatribes by communal politicians.” 

আবার অভিজিৎ পাঠক একজন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীর দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দুত্বের সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, এযাবৎকাল হিন্দু হিসেবে তিনি যা শিখেছেন এবং তাঁর ভেতরে যে ধর্মবোধ তৈরি হয়েছে তার থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম হল হিন্দুত্ব। “While the discourse of Hindutva with its hypermasculine nationalism is essentially monolithic and centralising, I have learned about the beauty of the elasticity of human consciousness and merger of multiple faiths and paths from the likes of Ramakrishna Paramahansa… Likewise, while Hindutva intensifies aggression, Mira’s bhajans teach me that love and religiosity are not separate. The character of ‘Anandamayee’ that Tagore created in his classic novel ‘Gora’ makes me see the enchanting power of maternity, the current that absorbs everything. And hence, I begin to see the hollowness in the assertion of brute masculinity seen in instances of mob lynching by zealots, which ruthlessly denies the possibility of an evolutionary journey towards what Sri Aurobindo regarded as the ‘divine consciousness’.”


[]

এটি লক্ষণীয় যে, ব্রিটিশ শাসনে আদমশুমারির অভিঘাতে হিন্দু শব্দের সীমায়নের কারণে বুদ্ধিজীবীদের যে অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছিল ও বিরোধিতার পথ নিয়েছিল তারা নিজেরা যে ‘হিন্দু’ ভাষ্য প্রস্তুত করল সেখানে ‘হিন্দু’ শব্দটিকে পুনরায় সংকুচিত করা হল। হিন্দু সংস্কৃতিকে হিন্দু ধর্ম থেকে বিভাজিত করার যে প্রকল্প সামনে রেখে হিন্দুত্বকে প্রস্তুত করা হয়েছিল তা বাস্তবে বৈচিত্র‍হীন একধর্মী রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। এই বিশ্বাস অনুযায়ী, হিন্দুত্বের লক্ষ্য হল, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি ও এক ধর্মের ভারতীয় জাতি প্রস্তুত করা। এরূপ জাতিরাষ্ট্র ইউরোপের ইতিহাসে সাফল্যের সঙ্গে বিচরণ করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারতের মতো একটি বহুভাষাভাষী ও বহুসংস্কৃতির রাষ্ট্র অভিন্ন হিন্দুত্বের হাত ধরে কি দীর্ঘ পথ চলতে পারবে?

ভারত ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অবশ্য  সে কথা বলে না। কালের ভারত যে কারণে ইতিহাসে সমাদৃত হয়েছে তা তার সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরল বৈচিত্র এবং অভাবনীয় সহনশীলতার মাত্রার কারণে। মনে রাখা দরকার, আদি শঙ্করাচার্য বৌদ্ধ ধর্মের প্লাবনকে রোধ করেছিলেন কোনও বিদ্বেষ দ্বারা নয়, বরং বুদ্ধদেবকে ‘হিন্দু’ অবতার রূপে স্বীকৃতি দিয়ে। শ্রীচৈতন্যদেবও বৈষ্ণব ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছিলেন সহনশীলতার আদর্শ দিয়ে। তবে, এর অর্থ এই নয় যে, ভারতের অতীত ইতিহাস সর্বদাই বিবাদ-বিসংবাদহীন ছিল, এখানে ধর্মীয় সংঘাত, নিপীড়ন একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। পরিবর্তে হিন্দু-জৈন, হিন্দু-বৌদ্ধ, শৈব-বৈষ্ণব, প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমাগত সংঘাত, বিদ্বেষ, এমনকি মন্দির ভাঙাভাঙির ঘটনাও ঘটেছিল। আবার, একাদশ ও দ্বাদশ শতকের বাংলার সেন রাজারাও ছিলেন, যারা তাঁদের বিশ্বাসের বিরোধী হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ  আচরণ করেছিলেন। এছাড়াও, গ্রিক, শক, হুন, মোগল বা পাঠান আক্রমণকারীরা এ দেশের সম্পদের লোভে এসেছিলেন এবং যথেষ্ট হিংসার আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু, একসময় এঁরা সকলেই বৈচিত্রময় ভারতীয় সভ্যতায় লীন হয়েছেন। 

বস্তুত নিষ্ঠুর অভিন্নতা অপেক্ষা বৈচিত্রকে স্বীকার করার অনেকগুলি সুবিধা রয়েছে। তবে, এই ক্ষণে আমরা দুটি সুবিধার কথা আলোচনা করব। প্রথমটি সাধারণ ও পরেরটি ভারত নির্দিষ্ট। মানব সভ্যতার সামগ্রিক বিকাশের জন্য কোনও একটি নির্দিষ্ট গুণ যথেষ্ট নয় — সভ্যতার পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য প্রয়োজন বিবিধ চিন্তা, চেতনা ও অনুশীলনের। কোনও ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের কাছে এই সকল গুণাবলি একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। কোনও একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বহুমুখী মানুষের সার্বিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতাও সীমিত।  ফলত, প্রয়োজন যৌথ জীবনচর্যার এবং আন্তঃসম্প্রদায়গত বোঝাপড়ার। উন্নত সমৃদ্ধ জীবনের আকাঙ্ক্ষা বৈচিত্রকে আবশ্যিক করে তোলে। যাঁরা এটা বোঝেন ও বিশ্বাস করেন তাঁরাই বহুত্ববাদী। বহুত্ববাদী ভাবনা দীর্ঘমেয়াদি সময়ে সভ্যতাকে শক্তি ও সমর্থন দেয়। বৃহত্তর বাস্তুতন্ত্রের জন্য যেমন জৈব-বৈচিত্র প্রয়োজন, তেমনি  আমাদের  মানব বিশ্বের জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র। 

বহুত্ববাদের পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তিটি অবশ্যই ভারত নির্দিষ্ট। ঐতিহাসিক ভাবে বিকশিত ভারতীয় সমষ্টিগত অবচেতন চরিত্র পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত। ইতিহাসের বিভিন্ন ক্ষণে যখনই সমস্যা এসেছে তখনই বহুত্ববাদী চেতনা সেই সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করেছে। রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে — সাম্প্রদায়িক জাতি শক্তির মাথাচাড়া দেওয়ার কালে, স্বাধীন ভারতের রাজ্যগুলির সীমানা পুনর্গঠন কালে বা অন্যান্য নানা ক্ষেত্রেও বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক চেতনা দেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। ভারতীয় সভ্যতার দীর্ঘ যাত্রার রহস্য হল যে এটি একটি বিশেষ ভাষা, একটি বিশেষ ভূগোল, একটি বিশেষ ধর্ম বা এমনকি একটি বিশেষ জাতিসত্তার ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হয়নি। ভারতীয়ত্বের ধারণা প্রাচীন সভ্যতা থেকে উদ্ভূত, একটি ভাগ করা ইতিহাস দ্বারা একত্রিত এবং আমাদের বহুত্ববাদী গণতন্ত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। স্বাধীন ভারতের সংবিধানও আমাদের যৌথ জীবনচর্যার আবহে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অনুশীলনের অনুমতি দেয়। এমতাবস্থায়, বহুত্ববাদী চিন্তনের বাইরে এসে অভিন্নতাকে ভারতীয় সভ্যতার অন্তরে প্রোথিত করা কতটা সম্ভব তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। 

[]

আমাদের দীর্ঘ আলোচনার পরিসমাপ্তি কালে একথা বলা প্রয়োজন যে, সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুত্ব, হিন্দু ধর্মের ও ভারতীয়ত্বের সমার্থকতা দাবি করলেও সেই দাবি ইতিহাসসিদ্ধ নয়। বরং হিন্দুত্ব হিন্দু ধর্মের বহিরঙ্গের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে প্রস্তুত করা এক রাজনৈতিক বিশ্বাস যা বিশেষ প্রকার রাজনৈতিক পরিচিতিকে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত। হিন্দুত্ববাদীরা আশা করেন যে, তাঁদের এই বিশ্বাস আগামী দিনে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে এক সুর ও এক লয়ে বেঁধে ফেলতে সমর্থ হবে। তাঁদের এই প্রত্যাশা সাম্প্রতিক সময়ে জনমানসের একটি বড় অংশের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সঞ্চারও করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিন্দুত্বের অভীষ্ট কি সিদ্ধ হবে? ভারতের বহুত্ববাদের মধ্যে একতার যে মহান ঐতিহ্য রয়েছে, যা দেশের মানুষের জাতিগত, ভাষাগত এবং সম্প্রদায়গত ভিন্নতাকে ঐকতানে বেঁধে রেখেছে, তা কি ক্রমশ এক কেন্দ্রীভূত জাতিবাদী রাষ্ট্রের ভাবনায় রূপান্তরিত হবে? ভারতীয় সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি কি তার ‘ডিফল্ট সেটিং’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। 

সহায়কগ্রন্থ : 

১. Arvind Sharma, ‘On Hindu, Hindustan, Hinduism and Hindutva’, Numen 49, no. 1 (2002)

২. M. S. Golwalkar, ‘We or Our Nationhood Defined’ (Nagpur, 1938)

৩. Tapan Basu, Pradip Dutta, Sumit Sarkar, Tanika Sarkar, Sambuddha Sen, ‘Khaki Shorts Saffron Flags’ (New Delhi: Orient Longman, 1993)

৪. V. D. Savarkar, ‘Essentials of Hindutva’ (Global Vision, 2021)

৫. Walter K. Andersen and Shridhar D. Damle, ‘The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism’ (New Delhi: Penguin, 2019)



No comments

Theme images by sndrk. Powered by Blogger.