কৃষ্ণের পবিত্র নাম আমাদের সর্বপ্রকার পাপ অনর্থ থেকে, সর্বপ্রকার দুঃখ থেকে মুক্ত করে
শ্রীমদ্ ভাগবতের শেষশ্লোকে বলা হয়েছে,—“কৃষ্ণের পবিত্র নাম।
শ্রীব্যাসের মহাবদান্যতাঃ
শ্রীমদ্ ভাগবতের শেষশ্লোকে বলা হয়েছে,—“কৃষ্ণের পবিত্র নাম আমাদের সর্বপ্রকার পাপ অনর্থ থেকে, সর্বপ্রকার দুঃখ থেকে মুক্ত করে । এস আমরা তাঁকেই প্রণাম করি ।”—এই বলেই সেই মহান্ গ্রন্থরাজ শ্রীমদ্ ভাগবত নীরব হন । শ্রীমদ্ ভাগবতের শেষ শব্দ ‘নামসংকীর্ত্তন’ । ভাগবত কৃষ্ণনামকীর্ত্তনকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন এবং শ্রীমন্মহাপ্রভু সেইখান থেকেই তাঁর অভিবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন । বেদসমূহের বিভাগকর্ত্তা ভগবান্ ব্যাসদেব তাঁর সর্বশেষ কৃতি শ্রীমদ্ ভাগবতে আস্তিকতাকে এই স্তর পর্য্যন্ত নিয়ে গিয়েছেন এবং তারস্বরে জগদ্ বাসীকে আহ্বান করে বলেছেন, “কৃষ্ণের নাম কীর্ত্তন কর । এইটাই কর, আর কিছুরই দরকার নাই” । শ্রীমদ্ ভাগবতের এইটিই সর্বশেষ উপসংহার বাক্য—ব্যাসদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ পারমার্থিক দান—‘কৃষ্ণনাম কীর্ত্তন কর’ এবং এই কলিযুগের সর্বোত্তম উদার পরমার্থপথ—‘কৃষ্ণনাম কীর্ত্তন’
অমৃত-ধারার অমৃতঃ
আমরা নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান্ বলে মনে করি, কারণ আমরা এই রকম একটি মহা উদার ও প্রয়োজনীয় সংকল্প গ্রহণ করেছি, তাঁর অত্যন্ত নিকটেই এসেছি, তাকে ধরাছোঁয়ায় মধ্যে পেয়েছি, তাঁকে আপন করে নিয়েছি এবং তার করুণাধারায় নিজেকে সাধ্যমত ভাসিয়ে নিয়েছি । অনেক জন্মের অনেক সুখ-সম্ভোগ লাভ করেছি, সে সব ছেড়ে দিয়ে এখন নামসংকীর্ত্তনের রসাম্বুধির কিনারায় এসে পড়েছি । এখন আমরা গুরুবৈষ্ণবের কৃপায় এই নামসংকীর্ত্তন-রসামৃতের তরঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার দেওয়া আরম্ভ করি ।
এ সব তাঁদের সম্পদ, আর আমরা তাঁদের দাস । তাই আমাদের এত সাহস যে, আমরা সেই নামকীর্ত্তনের অমৃতসাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পেরেছি, তাতে সাঁতার কাটছি । কোন ক্ষেত্রে শ্রীরাধাকুণ্ডে—পরমার্থলাভের শেষ পর্য্যায়ে অবগাহন করা! এও সম্ভব নাম-সংকীর্ত্তনের সর্ব্বোচ্চ স্তরে পৌঁছালে । এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ-নামসংকীর্ত্তনরসসাগরের positive side-টীই প্রকাশ পেয়েছে । পরবর্ত্তী শ্লোকে তার negative possibilities দেখান হয়েছে ।
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শিক্ষাষ্টকের সংস্কৃতটীকা রচনা করে, তার বাঙ্গলা অনুবাদও নিজে লিখেছেন, এবং সেই টীকাই সবচেয়ে original representation । শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদও শিক্ষাষ্টকের একটি টীকা লিখেছেন । এই সব তত্ত্ব ভালভাবে বুঝবার জন্য সেই টীকাগুলি বিশেষভাবে অধ্যয়ন করা দরকার । আমি আমার হৃদয়ে যতটুকু অনুভব করেছি, সেইটুকুই এখানে প্রকাশ করছি । শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর, শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শ্রীরূপ গোস্বামী, শ্রীসনাতন গোস্বামী, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং পূর্ববর্তী আচার্য্যগণের কাছ থেকে যা পেয়েছি তা থেকে আমার মনে যা এসেছে তাই প্রকাশ করছি । তাঁদের করুণায় তা আমার ভাণ্ডারে গচ্ছিত আছে; তারই সারমর্ম আমি পরিবেশন করছি
কৃষ্ণচেতনা সর্ববিজয়ীঃ
ভক্তির পথ আশ্রয় করলে আমাদের অন্তরাত্মার সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন ঘটে থাকে এবং ক্রমশঃ জড়জগতের যাবতীয় charm—প্রলোভন দূর হতে থাকে । ভেতরে একরকম সংগ্রাম চলতে থাকে এবং কৃষ্ণচেতনা যখন সাধকের চিত্তকে গ্রাস করে ফেলে, তখন আর যা কিছু চিন্তা ও ধারণা সবই চলে যায় । শ্রীমদ্ ভাগবতে এটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে,—
প্রবিষ্টঃ কর্ণরন্ধ্রেণ স্বানাং ভাবসরোরূহম্ ।
ধুনোতি শমলং কৃষ্ণঃ সলিলস্য যথা শরৎ ॥
(ভাঃ ২।৮।৫)
শরৎকাল এলেই জলের কাদাগুলো আপনিই তলায় পড়ে যায়, জল নির্মল হয়ে যায় । যখন কৃষ্ণচেতনা হৃদয়ে প্রবেশ করে, তখন আর সব কামনা-বাসনা, জানা-অজানা, সব চিন্তাধারা আপনা হতেই ক্রমশঃ মন থেকে সরে যায়, কৃষ্ণচিন্তাই হৃদয়টাকে পুরোপুরি অধিকার করে । কৃষ্ণের একবিন্দু কৃপা মন থেকে, হৃদয় থেকে সবকিছুকেই সরিয়ে নিজেই ভক্তের হৃদয় দখল করে ।
এইটাই কৃষ্ণচেতনার স্বভাব । কোন কিছুই তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না । সে তথাকথিত দেব-দেবী পূজাই হোক অথবা খৃষ্টান্, ইস্ লামধর্মধারণাই হোক—সবই মন থেকে চলে যায় । আস্তিকতার আর যত সব চিন্তা-চেতনা আছে, সবই কৃষ্ণচেতনার কাছে হার মেনে পালিয়ে যায় । কৃষ্ণের সৌন্দর্য্য ও মাধুর্য্যের কাছে কেউই দাঁড়াতে পারে না ।
সৌন্দর্য্য, মাধুর্য্য ও চমৎকারিতা সব শক্তিকেই হার মানায়—বশ করে ফেলে । আমরা ত’ বাস্তবিকই কেবল সৌন্দর্য্য, মাধুর্য্য, করুণা, ও প্রেমের পিয়াসী । আত্মস্বার্থ-ত্যাগের মধ্যে এমন বল ও ঔদার্য্য রয়েছে, তা সব কিছুর উপরেই জয়লাভ করে—সব অভাবকেই পূরণ করে নেয় । পাওয়ার চেয়ে দেওয়াতেই যে বেশী লাভ! অপ্রাকৃত প্রেম মানেই বাঁচার জন্য মরা, নিজের জন্য বাঁচা নয়, পরের জন্য বাঁচা । চরম ত্যাগ, চরম উৎসর্গ কেবল কৃষ্ণচেতনার মধ্যেই সম্ভব ।
কৃষ্ণচেতনার মধ্যে এমন সৌন্দর্য্য আছে, যার হৃদয়ে তার আবির্ভাব হয়, সে নিজের পরিচয় এমন কি নিজের সত্ত্বাও হারিয়ে ফেলে । সে পুরোপুরি আত্মবিস্মৃত হয়ে যায়, এমনই তার চমৎকারিতা । কে ই বা কৃষ্ণের কাছে দাঁড়ায় ? যে ভাবনাই আসুক, তার কাছে সবই নিরস্ত্র হয়ে য়ায় । যদি কোনও প্রকারে কৃষ্ণ হৃদয়ে প্রবিষ্ট হন, তা হলে আর কোন কিছুই সেখানে স্থান পায় না । সবই কৃষ্ণের অধিকারে এসে যায় । কৃষ্ণ এমনই উদার, এমনই সুন্দর, এমনই মধুর, এমনই সৌন্দর্য্য, সৌকুমার্য্য ও মাধুর্য্যের মূর্ত্তবিগ্রহ!
হরে কৃষ্ণ জয় রাধেঁ রাধেঁ,,
No comments