Header Ads

চট্টগ্রাম জুড়ে ধর্ষণ আর ধর্ষণ আর ধর্ষণ!

চট্টগ্রাম জুড়ে ধর্ষণ আর ধর্ষণ আর ধর্ষণ!

চট্রগ্রাম

দেশে আইন আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। তারপরও একের পর এক যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং এ সংক্রান্ত খুনের ঘটনা ঘটেই চলছে। চট্টগ্রামে এক মাসে ৯ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা ও ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটেছে। দিনরাত ধারাবাহিকভাবে একই স্টাইলে এ জাতীয় যৌন সন্ত্রাসের ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক নেমে এসেছে কর্মজীবী নারী-শিশু ও ছাত্রী-শিক্ষিকা ও গৃহবধূদের মাঝে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেই নারী ও শিশু লাঞ্ছনার ঘটনা বেড়ে চলেছে। বিচারহীনতা ধর্ষণকারীদের উৎসাহিত করছে। আকস্মিক এ ধরনের যৌন সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্যে সর্বত্র উদ্বেগ নেমে এলেও পুলিশ হাঁটছে সেই পুরনো পথেই। পুলিশ বলছে, এসব বিছিন্ন ঘটনা। মাঝে মাঝে এ জাতীয় অপরাধ একত্রে ঘটে বলে মনে হয়, হঠাৎ বেড়ে গেছে।

এর মধ্যে গতকাল (২৫ এপ্রিল) হাটহাজারি থানার ওসিসহ (অপারেশন) ১৫ জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এ শ্লীলতাহানির অভিযোগে মোছাম্মৎ নার্গিছ নামের এক নারী বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় হাটহাজারী থানার পরিদর্শক মো. শামীম শেখ সহ (ওসি অপারেশন) ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার বিবরনী থেকে জানা যায়, অভিযোগকারী এবং অন্য তিনজন ভিকটিমকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে আসছিল আসামিরা। বিষয়টি হাটহাজারী থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে ডিউটি অফিসার শামীম শেখের (ওসি অপারেশন) সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি (শামীম শেখ) বাদী অভিযোগকারীদের কোনরূপ সহায়তা না করে আসামিদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভিকটিমদের অপহরণ করতেও সহায়তা করেন। কোনরূপ উপায়ন্তর না দেখে অভিযোগকারীর আত্মীয়রা ৪ এপ্রিল র‌্যাব-৭ এর সিইও বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন। র‌্যাব ৫ এপ্রিল নগরীর প্লাজমা হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ভিকটিমকে উদ্ধার করেন এবং ইয়াছিন ও মইনুল নামের ২ অপহরণকারীকে আটক করেন। অন্যদিকে আসামিদের আস্তানা থেকে জোৎস্না ও নিরুফা পারভিনকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উদ্ধার করেন হাটহাজারী থানার এস আই রুহুল আমিন। মামলায় আসামিরা ভিকটিমদের শ্লীলতাহানি এবং ধর্ষণ চেষ্টা করে।

গত ২২ এপ্রিল পটিয়া উপজেলার বড় উঠান এলাকায় পোশাক কারখানায় কর্মরত এক তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে। কারখানা থেকে ফেরার পথে রাতে বড়উঠান ইউনিয়নের দৌলতপুরে ওই তরুণীকে দুই যুবক ধর্ষণের চেষ্টা করে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ওই তরুণী বাধা দিতে গিয়ে নাক, মুখ, গাল ও ঘাড়ে আঘাত পেয়েছেন। ওই পরিবারের পক্ষ থেকে ২৩ এপ্রিল রাতে থানায় মামলা হয়। বর্তমানে তরুণীটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।

একইদিনে ২২ এপ্রিল চকরিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭ বছর বয়সী অবুঝ এক শিশু নিজ বাড়ির অল্প দূরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়তে যায়। ওইদিন রাত ৯টায় প্রাইভেট শেষে আরো কয়েকজন সঙ্গীর সাথে বাড়ি ফিরছিল সে। পথিমধ্যে নরপশুতুল্য যুবক নুরুল ইসলাম (৩৪) ওই শিশুকে ধরে কাঁধে তুলে একশ গজ দুরে মাতামুহুরী সেতুর নিচে নিয়ে যায়। সেখানে শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় সে। শিশুসহ সঙ্গীরা চিৎকার শুরু করলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে শিশুটিকে উদ্ধার ও ধর্ষণ চেষ্টাকারী নুরুল ইসলামকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে।
১৮ এপ্রিল বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের টেকপাড়া গ্রামে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ধর্ষিতার পিতা মোস্তফা আলী বাদি হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। জানা যায়, ওই ছাত্রী বাড়ির পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতে ঘাস কাটতে যায়। এ সময় শিশুটিকে একা পেয়ে একই এলাকার শামশুল আলমের পুত্র আবদুল হাকিম প্রকাশ মিন্টু (৩০) ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর ওই ছাত্রীর রক্তক্ষরণ হওয়ায় ধানক্ষেতে ফেলে মিন্টু পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ধর্ষিতার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে। পরে রক্তপাত বন্ধ না হলে তাকে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় তার পরিবার। বর্তমানে শিশুটি চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। এদিকে ২২ এপ্রিল র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ওই শিশু ধর্ষক নিহত হয়েছে।

১৬ এপ্রিল লোহাগাড়ায় ৮ম শ্রেণির এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানীর চেষ্টার অভিযোগে ৪ স্কুল ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিস্কৃতরা হল উপজেলার সাকিল আহমদ, মো. রায়হান, মো. আবু জায়েদ ও আবু মো. আদনান। তারা সকলে দক্ষিণ সাতকানিয়া গোলামবারী মডেল উচ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্র। ওইদিন আমিরাবাদ সুফিয়া আলিয়া মাদ্রাসার ৮ম শ্রেণির এক ছাত্রী আমিরাবাদের ডলুকুল হতে খান সড়ক হয়ে মাদ্রাসায় আসছিল। পথিমধ্যে ওতপেতে থাকা ৪ জন ছাত্র ছাত্রীটিকে জোরপূর্বক টানাটানি করে মাটিতে ফেলে দেয়। পরে লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে পেয়ে অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়। ঘটনা জানাজানি হলে ছাত্রীর অভিভাবক বিষয়টি ওইদিনই লোহাগাড়া থানাকে অবহিত করেন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে ২২ এপ্রিল অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্তদেরকে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়।

১০ এপ্রিল দুপুরে সন্দ্বীপীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুব আলী চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ডেকে নেন। স্কুলের পাশে একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। পরে ওই ছাত্রী বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে গিয়ে কাউকে কিছু না বললেও পরদিন থেকে ওই ছাত্রী স্কুলে যাওয়া-আসা বন্ধ করে দেয়। স্কুলে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে কান্না জড়িত কণ্ঠে তার মাকে পুরো বিষয়টি খুলে বলে। এর প্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীর বাবা ১৭ এপ্রিল সকালে বাঁশখালী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই প্রধান শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে অভিযুক্ত শিক্ষক কারাগারে রয়েছে।

৪ এপ্রিল সাতকানিয়া উপজেলার চিব্বারি এলাকায় ৫ বছরের কন্যা শিশুকে যৌন হয়রানির অভিযোগে মো. রুহুল আমিন নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনার পর ওই শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সাতকানিয়া থানা পুলিশকে ঘটনা অবহিত করা হলে ওই শিক্ষককে ওইদিন মাদ্রাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় যৌন হয়রানির শিকার শিশুটির মা বাদি হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।

এদিকে ২০১১ সালের ৮ জুন দক্ষিণ কাট্টলীর হরিমন্দির এলাকার চন্দনা রাণী দাশের মেয়ে পান্নাকে তিনজন মিলে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় গত ৩ এপ্রিল ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকায় একই এলাকার সুজন ঘোষ, যদু ঘোষ ও সমীর দে’কে মৃত্যুদ- দিয়েছেন চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক বেগম রোখসানা পারভিন এই রায় দেন। পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

২ এপ্রিল দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পর্যটন স্পট বাঁশখালী ইকোপার্কে চাচাতো ভাইদের নিয়ে বেড়াতে এসে এক স্কুল ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নগরীর পতেঙ্গায় বসবাসকারীর ছদ্মনাম (মাহি) তার চাচাতো ভাইদের সাথে বাঁঁশখালী ইকোপার্কে বেড়াতে গেলে পার্কের উঁচু-নিচু পাহাড় ও টাওয়ার ঘুরার সময় সেখানে পূর্ব থেকে ওৎ পেতে থাকা ৩ বখাটের কুনজরে পড়ে স্কুল ছাত্রীটি। বখাটেরা এক পর্যায়ে তার সাথে থাকা চাচাতো ভাইদের ধাওয়া করে পালাক্রমে স্কুল ছাত্রীটিকে ধর্ষণ করে। ছাত্রী এবং তার চাচাতো ভাইদের চিকিৎকারে পর্যটক ও বন কর্মকর্তা তাদের ধাওয়া করে ৩ ধর্ষককে আটকের পর পুলিশকে সোর্পদ করেন।

১৫ মার্চ বিকেলে নগরীর বন্দর থানার কলসিদিঘি এলাকায় ৫ বছরের এক শিশুকে চকলেট দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ডেকে নেয় বাড়িটির কেয়ারটেকার আল মামুন। ভবনের একটি কক্ষে ধর্ষণের চেষ্টা করলে শিশুটি ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। এসময় আশপাশের লোকজন মেয়েটিকে উদ্ধার করে। এলাকায় ওই ব্যক্তি নিজেকে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচয় দেয়। ফলে ১৫ এপ্রিল ঘটনা ঘটলেও তা ধামাচাপা দেওয়া চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয়দের চাপের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ফলে মেয়েটির পরিবার থানায় মামলা দায়ের করে। এরপর ১৭ মার্চ ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে আল মামুনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এদিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জাতীয় অপরাধ আগেও ঘটত। এখন তার কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকাশও পাচ্ছে ব্যাপক হারে। এজন্য দায়ী অনেকগুলো ফ্যাক্ট। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় ঘৃণিত এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরোধ না করা গেলে সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সমাজবিজ্ঞানী ডক্টর অনুপম সেন এর মতে ইন্টারনেটের যথেচ্ছ ব্যবহার ও পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির কারণেরই ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। আইনের সঠিক প্রয়োগটাও জরুরী। পাশের দেশ ভারতে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আমাদের দেশেও মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা উচিত। একসময় এসিড সন্ত্রাস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো। যখন এসিড সন্ত্রাসের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হল তখন এসিড নিক্ষেপের ঘটনা শূন্যের কোটায় নেমে আসলো। তাই ধর্ষনের ঘটনায়ও মৃত্যুদন্ডের কোন বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ প্রতিনিধি আমিনুল হক বাবু সিভয়েসকে বলেন, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুললে সেখান থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। তার মতে, ধর্ষণ আগেও ছিল এখনও রয়েছে। তবে মিডিয়ার বিকাশের কারণে এখন তা বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। একমাত্র সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।



No comments

Theme images by sndrk. Powered by Blogger.