Header Ads

দুর্গা পূজার প্রচলণ - পুরান থেকে ইতিহাস। মূল রামায়ণে দুর্গা পূজার অস্তিত্বই নেই-----

দুর্গা পূজার প্রচলণ - পুরান থেকে ইতিহাস। 

মূল রামায়ণে দুর্গা পূজার অস্তিত্বই নেই-

লেখক- শ্রী রূপেশ সামন্ত।



অকালবোধন’ কেন? ‘বারোয়ারী’ পূজা বলে কেন? ‘মহাভারতে’ কি দুর্গা পূজা আছে? রাবন কি দুর্গা পূজা করতেন? পুরান থেকে ইতিহাস- দুর্গাপূজার বিবর্তন নিয়ে লেখা।

দুর্গা পূজা বাঙালীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্বজনীন উৎসব। আশ্বিন ও চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে দুর্গা পূজা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গা পূজা শারদীয়া দুর্গা পূজা ও চৈত্র মাসের দুর্গা পূজা বাসন্তী দুর্গা পূজা নামে পরিচিত।

-------শরৎ কালের দুর্গা পূজাই ‘অকালবোধন’----

রামায়নে রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দু মতে, শরৎকালে দেবতারা নিদ্রা দেন। তাই শরৎকালে পূজা করার বিধি নেই। কিন্তু অকালে রাম এই দুর্গা পূজা করেছিলেন বলেই শারদীয়া দুর্গা পূজাকে অকালবোধন বলে।

-----মূল রামায়ণে দুর্গা পূজার অস্তিত্বই নেই-----

রামায়নের রচয়িতা ছিলেন বাল্মিকী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সেই মূল রামায়নে অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গা পূজার কোন উল্লেখই নেই। কিন্তু কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। ব্রহ্মাই দুর্গার পূজা করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল অশুভ শক্তির বিনাশ করার জন্য রামকে সাহায্য করা। কৃত্তিবাস ওঝা তার লেখা রামায়ণে কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ এর ঘটনাকে কিছুটা পরিবর্তন করেছিলেন। তার লেখা রামায়ণ থেকে জানতে পারি, রাম নিজেই শরৎকালে দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। সেখানেও উদ্দেশ্য ছিল অশুভ শক্তি বা আসুরিক শক্তি রাবনের বিনাশ।


------ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে কৃষ্ণই প্রথম দুর্গাপূজা করেন-----
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে কৃষ্ণই দুর্গাপূজার প্রচলন করেছেন। সৃষ্টির প্রথম পর্বে কৃষ্ণ আদি-বৃন্দাবন ক্ষেত্রের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেন। তিনি দুর্গা পূজা করেছিলেন কৈটভ ও মধু নামে দুই অসুরকে নিধন করার জন্য। এরপর তৃতীয় দুর্গাপূজা করেন শিব। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে শিব পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে সংকটাপন্ন হন। তখন বিপন্মুক্ত হওয়ার জন্য শিব দুর্গার পূজা করেন। এরপর ইন্দ্র চতুর্থ দুর্গা পূজা করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন শাপমুক্তির জন্য। এরপর থেকেই হিন্দুরা নিয়মিত দুর্গা পূজা করে আসছে।
-------দেবীভাগবত পুরাণ মতে মনু দুর্গা পূজার প্রচলন করেন-----
দেবীভাগবত পুরান অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র ছিলেন মনু। তিনি পৃথিবীর শাসক হিসাবে নিযুক্ত হলেন। এরপর তিনি ক্ষীরোদসাগরের তীরে দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি রচনা করে পূজা করেন এবং তিনি ঘোর তপস্যায় রত হলেন। একশো বছর ধরে তিনি তপস্যা করেন। দুর্গা প্রীত হলেন। মনুকে বর দিলেন। দুর্গা মনুর শাসন কার্যের পথ নিস্কন্টক করলেন। দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে এইভাবে পৃথিবীতে দুর্গা পূজার প্রচলন হল।

মার্কেণ্ডেয় পুরাণ মতে সুরথ দুর্গা পূজার প্রচলন করেন -----
মার্কেণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম অংশে দুর্গা পুজা প্রচলনের কাহিনী জানা যায়। সুরথ ছিলেন পৃথিবীর রাজা। অত্যন্ত প্রজাহিতৈসী ছিলেন তিনি। যবন জাতির কাছে তিনি এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যান। জঙ্গলে আশ্রয় নেন। মেধা নামে এক ঋষির আশ্রমে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু সেখানেও তিনি হারানো সাম্রাজ্যের প্রজাদের কথা ভাবতে থাকেন। তাদের কল্যান-অকল্যানের চিন্তা করতে থাকেন। এরপর রাজার একদিন দেখা হয় সমাধি নামে এক বৈশ্যর সঙ্গে। তাঁর থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পুত্ররা তাকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু তা সত্বেও তিনি স্ত্রী-পুত্রের কল্যান-অকল্যানের চিন্তা করতে থাকেন। দুজনেই ঋষির কাছে জানতে চাইলেন তাদের এইরূপ দুঃশ্চিন্তার কারণ কি। ঋষি তাদেরকে মহামায়া বা দুর্গার মায়ার কথা বললেন। তিনি সুরথকে দুর্গার মধু ও কৈটভ দৈত বধের কাহিনী, মহিষাসুর বধের কাহিনী এবং শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুর বধের কাহিনী বললেন। ঋষির গল্প শুনে সুরথ তিন বছর কঠিন তপস্যা ও দুর্গা পূজা করেন। তপস্যায় প্রীত হয়ে দুর্গা সুরথকে হারানো সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন এবং সমাধিকে তত্ব উপদেশ দিলেন। এইভাবে পৃথিবীতে দুর্গা পূজার প্রচলন হয়ে গেল। সুরথ এই পূজা বসন্ত কালে করেছিলেন বলে একে বাসন্তী পূজাও বলা হয়।
-------কৃত্তিবাসি রামায়ণে দুর্গা পূজা করেন রাম-----


কৃত্তিবাস ওঝা তার লেখা রামায়ণে কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এর কাহিনি অত্যন্ত সুনিপুন ভাবে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গা পূজার কোন উল্লেখ নেই। কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ অনুসারে, রাবনকে বধ করার জন্য ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন শিবের স্ত্রী দুর্গাকে পূজা করার জন্য। কেননা, রাবন ছিলেন শিব ভক্ত। শিবের স্ত্রী দুর্গাকে পূজা করলেই শিব তুষ্ট হবেন। তখন রাম শরৎকালে দুর্গার বোধন, চণ্ডীপাঠ ও পূজার আয়োজন করেন। তুষ্ট হয়ে দুর্গা রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন। কৃত্তিবাস কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণের কাহিনীর কিছুটা পরিবর্তন করেন। ঐ দুই পুরাণ অনুসারে দুর্গার পূজা করেন ব্রহ্মা। কিন্তু কৃত্তিবাসি রামায়ণে দুর্গার পূজা করেন রামচন্দ্র।

------কালিকা পুরাণ মতে রাবনও দুর্গা পূজা করতেন-----


কালিকা পুরাণ অনুযায়ী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন এবং স্বর্গ রাজ্য দখল করেছিলেন। মহিষাসুর ব্রহ্মার বরে বলিয়ান ছিলেন। এরপর অসুরকে বিনাশ করতে বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারা সমবেত হয়ে তাদের তেজ থেকে দুর্গার সৃষ্টি করলেন। সেই দুর্গাই বিনাশ করে অসুরকে। রাবন ত্রেতাযুগে চৈত্র মাসে দুর্গা পূজা করতেন।

-------বৃহদ্ধর্ম পুরাণ মতে ব্রহ্মা দুর্গা পূজা করেন -----

এই পুরাণের মতে, রাম-রাবনের যুদ্ধে রামকে সাহায্যের জন্য কুম্ভকর্নের নিদ্রাভঙ্গ করা হল। এরপর রাবন বধে রামচন্দ্রের মঙ্গল কামনায় সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা দুর্গার পূজা করতে চাইলেন। কিন্তু তখন শরৎকাল, দক্ষিনায়ন। দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। অসময়ে ব্রহ্মা দুর্গা পূজা শুরু করলেন। দুর্গা উগ্রচণ্ডী হলেন। ব্রহ্মা তাকে সন্তুষ্ট করে ততদিনই দুর্গা পূজা করতে থাকলেন, যতদিন না রাবন বধ হয়। এরপর দেবী দুর্গার কৃপায় নবমীতে রাবন বধ হয়। দশমীতে রামের বিজয়োৎসব। রামের অকাল বোধনের পরই দুর্গা পূজা ব্যাপক প্রচার লাভ করে।

কৃত্তিবাসি রামায়ণে দুর্গা পূজা করেন রাম-----
বৃহন্নন্দীকেশর পুরাণে রামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গা পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়।
-------মহাভারতে দুর্গা পূজার অস্তিত্ব রয়েছে----
মহাভারত অনুসারে, দ্বারকা নগরীতে শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গার পূজা হত। যুদ্ধক্ষেত্রে পান্ডব পক্ষের অর্জুন ও প্রদুন্ম দুর্গা পূজা করেছিলেন।
-------বারো ‘ইয়ারে’র পূজা বলেই ‘বারোয়ারী’ পূজা------
১৭৯০ সাল নাগাদ দুর্গা পূজায় আকৃষ্ট হয়ে হুগলি জেলার গুপ্তি পাড়াতে বার জন বন্ধু [বারো ইয়ার] মিলে চাঁদা তুলে প্রথম সার্বজনীন দূর্গা উৎসবের আয়োজন করেন। এই পূজা বারো বন্ধু বা বারো ইয়ারের পূজা বলেই ‘বারোয়ারী’ পূজা নামে পরিচিতি পায়।
-------দুর্গা পূজা প্রথম প্রচলনের ইতিহাস অন্ধকারময়-----

বিভিন্ন পুরাণে আমরা দুর্গা পূজার উল্লেখ পাই। একই ভাবে ইতিহাসেও প্রাচীন কালে দুর্গা পূজা প্রচলনের সত্যতা নিরূপিত হয়। তবে কবে, কোথায় প্রথম দুর্গা পূজা চালু হয়েছিল সে বিষয়ে প্রামান্য কোন তথ্য নেই। সিন্ধু সভ্যতায় পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দুর্গা ছিলেন শিবের অর্ধাঙ্গিনী। সেই হিসাবে তখন দুর্গারও পূজা হয়ে থাকতে পারে। ৯ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে বাংলার বিভিন্ন স্থানে মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি আবিস্কৃত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, ঐ সময় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। একাদশ শতাব্দীতে পন্ডিত ভবদেব ভট্ট দুর্গার মাটির মূর্তি পূজার কথা বলে গেছেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ‘দুর্গা ভক্তি-তরঙ্গিণী’ ও বাঙালি পন্ডিত শূলপাণি ‘দুর্গোৎসব-বিবেক’ বই দুইটিতে দুর্গা পূজার উল্লেখ করে গেছেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দূর্গা পূজা করেছিলেন। প্রচলিত আছে যে, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬-১৬০৫) রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন । অন্যমতে, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তার রাজত্বকালে (১৭১০-১৭৮৩) প্রথম দুর্গা পূজার প্রচলন করেন। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা পূজা করেছিল বলে মনে করা হয়। আধুনিক দূর্গা পূজা ১৮শ শতকে নানা বাদ্য যন্ত্র প্রয়োগে প্রচলন ছিল। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দূর্গা পূজার অঙ্কন চিত্র পাওয়া গেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, বড়শিয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী, কোচবিহার রাজবাড়ি সর্বত্রই মহাসমারোহে দুর্গোৎসবের আয়োজনের তথ্য পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয়রাও দুর্গোৎসব করত। উনিশ শতকে কলকাতায় বিপুল আয়োজনে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে দুর্গোৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে পরিনত হয়েছে।
তথ্যসূত্র- গরুড় পুরান, মার্কেণ্ডেয় পুরান, উইকিপিডিয়া, অষ্টাদশ পুরান সমগ্র- কামিনী প্রকাশনালয়, কৃত্তিবাসী রামায়ন, মহাভারত, সনাতন ধর্মতত্ত্ব



No comments

Theme images by sndrk. Powered by Blogger.