Header Ads

কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর মধ্যে কি পার্থক্য?

কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর মধ্যে কি পার্থক্য?


টাইটেল দেখেই নিশ্চয়ই আপনার চোখ কপালে উঠেছে? ভাবছেন, কৃষ্ণ আর বিষ্ণুতে আবার কি তফাৎ হতে পারে?

যিনি কৃষ্ণ তিনি বিষ্ণু তিনি পরমেশ্বর

পরমব্রহ্ম পরাৎপর দেব নমস্কার

এই মন্ত্রটি কি তাহলে মিথ্যা হয়ে গেল? আজ্ঞে না। কৃষ্ণ ও বিষ্ণু একজন হলেও বৈষ্ণবমতে তাদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। আর এই পার্থক্যগুলো করেছেন স্বয়ং শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর । আবারও বলছি কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর মধ্যকার এই পার্থক্যগুলো নিরূপণ করেছেন স্বয়ং শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর। তাই, যারা কৃষ্ণতত্ত্ব, বিষ্ণুতত্ত্ব বা বৈষ্ণবতত্ত্বের নিগুঢ় রস আস্বাদন করতে চান তারা ভিডিওটি সম্পুর্ণ দেখুন।

 

কৃষ্ণ ও বিষ্ণু তত্ত্বতঃ এক ও অভিন্ন সত্বা । উভয়েই ভাগবত তত্ত্ব, পূর্ণতত্ত্ব ও শক্তিমান তত্ত্ব।  কিন্তু এই দুই সত্বার মধ্যে রয়েছে ৯টি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।

১ম পার্থক্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ দ্বিভুজ এবং মুরলীধর এবং বিষ্ণু চতুর্ভুজ ও শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী।

কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর মধ্যে একমাত্র দৃষ্টিগত পার্থক্য হচ্ছে তাদের মুর্তিতে। শ্রীকৃষ্ণ দুই হস্তবিশিষ্ট এবং বংশীবাদন করেন, অন্যদিকে শ্রীবিষ্ণু চার হস্তবিশিষ্ট এবং শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী। এছাড়া কৃষ্ণ ও বিষ্ণুতে বাকী সমস্ত পার্থক্যই তাদের গুনের বা বৈশিষ্টের পার্থক্য।

এ প্রসঙ্গে, ২য় পার্থক্যটি হচ্ছে মাধুর্য বিগ্রহ কৃষ্ণই ঐশ্বরিক মূর্তিতে বিষ্ণু বা নারায়ন।


যেমন ধরুন একজন হাইকোর্টের জাজ। তিনি যখন কোর্টে বসে আছেন তখন তিনি তার সম্ভ্রম ভাব বজায় রেখে তার কার্য পরিচালনা করছেন। এখানে তিনি গুরুগম্ভীর এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তার ব্যাক্তিত্ব প্রদর্শন করছেন। আবার তিনিই যখন তার কোর্টের কাজ সেরে বাড়িতে ফিরলেন তখন তিনি একেবারে আলাদা এক মানুষ। এখানে তিনি হেসে খেলে কথা বলছেন, পরিবার পরিজন বা নাতি নাতনিদের নিয়ে আনন্দে মজে আছেন। ঠিক তেমনিভাবেই শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণু তত্ত্বতঃ একই ব্যাক্তি হলেও তিনি যখন ঐশ্বরিক মূর্তিতে বা বিষ্ণু হিসেবে অবস্থান করেন তখন সংগত কারনেই তিনি তার সম্ভ্রম ভাব বজায় রাখেন। আবার তিনি যখন বৃন্দাবনে ব্রজের গোপাল হিসেবে অবস্থান করেন তখন তিনি আনন্দপূর্ণ এক মাধুর্যবিগ্রহ রূপ ধারন করেন।


 


৩য় পার্থক্য হচ্ছে বিষ্ণুতে ৬০টি গুন পূর্ণমাত্রায় আছে অপরদিকে কৃষ্ণতে ৬৪ টি গুন পরিপূর্ণ মাত্রায় বিরাজিত।


অর্থাৎ, শ্রীনারায়নের ৬০ টি গুন ছাড়াও আরও অতিরিক্ত ৪ টি গুনের অধিকারী হলেন শ্রীকৃষ্ণ। এখানে উল্লেখ্য, ভগবান শিবের গুণের সংখ্যা ৫৫টি এবং প্রজাপতি ব্রহ্মার মধ্যে ৫০টি গুণ বিরাজিত। সুতারাং সর্বাধিক গুণের বিচারে শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীনারায়নেরও উপরে স্থান দেওয়া হয়।

৪র্থ পার্থক্য হচ্ছে কৃষ্ণ লক্ষীর মন হরণ করিতে পারেন কিন্তু বিষ্ণু কৃষ্ণকান্তা ব্রজগোপীদের মন হরণ করিতে পারেন না।


দেবী শ্রীলক্ষী বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলা ও রাসলীলার কথা শ্রবণ করে অতি আগ্রহে বৃন্দাবনে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। এ ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত হয় শ্রীকৃষ্ণ মর্ত্যধামে থেকেও শ্রীলক্ষীর মন হরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্যদিকে শ্রী বিষ্ণু রাসলীলায় অংশগ্রহণকারী গোপিনীদের মন হরণ করতে পারেননি। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন বৃন্দাবনে রাসলীলা চলাকালীন সময়ে গোপীকারা মনে মনে গর্বিত হয়ে উঠলে শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হন। এরপর গোপিনীরা উন্মাদের মত সন্ধান করছিলেন শ্রীকৃষ্ণের। এসময় শ্রীকৃষ্ণ শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী চতুর্ভুজ নারায়নের রূপ ধারন করে গোপীকাদের দর্শণ দেন। গোপীকারা শ্রীবিষ্ণুর দর্শন লাভ করে প্রনাম করেন এবং আনন্দিত হন। এরপর তারা বিষ্ণুর কাছে শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান জানতে চেয়েছিলেন। সুতারাং বুঝতেই পারছেন, গোপীকাদের মন শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হরণ করতে পারেন, স্বয়ং বিষ্ণুও না।


৫ম পার্থক্য হচ্ছে শান্ত, দাস্য ও সখ্যার্ধ অর্থাৎ গৌরব সখ্য এই আড়াই প্রকার রসে বিষ্ণুর সেবা হয় কিন্তু কৃষ্ণের সেবা শান্ত, দাস্য, বিশ্রম্ভসখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রস এই পঞ্চরসে সর্বোতভাবে প্রগাঢ় প্রীতির সহিত নিজ পতি, পুত্র প্রভৃতি জ্ঞানে হইয়া থাকে।


এই আড়াই প্রকার রস বা পঞ্চরস সম্পর্কে জানতে হলে রস বা রসোপভোগ কি তা সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে নেওয়া যাক। রসতত্ত্ব ও শক্তি-সাধনা গ্রন্থে সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য লিখেছেন,  প্রকৃতি-পুরুষ অর্থাৎ শ্ৰীশ্ৰীরাধা-কৃষ্ণ লিপ্ত রস-রাস বিহার করেন। এই চিৎধাম—এই রস-রাসমণ্ডল পূর্ণতম সুখরসে অবস্থিত ও জ্যোতিঃস্বরূপ কামবীজ মহামস্ত্রে সম্মিলিত । এই কমলের অষ্টদলে অর্কুসমী এবং কিঞ্জস্ব ও কেশরসমূহে অসংখ্য গোপী বিরাজিত । এই

স্থলেই রসিকশেখর পূর্ণতম রস-রাস-বিহারী শ্ৰীকৃষ্ণ স্বকীয় পূর্ণতম হ্লাদিনীশক্তি রাধিকা সহ নিত্য-লীলা করিতেছেন। জীব এই রস রাস-লীলা মুখী হইতে পারিলেই, তাহার পূর্ণ সুখ লাভ হয়। ইহাই পূর্ণানন্দ,—এই আনন্দের অনুভূতি জীবের অাছে,—জীব ইহা প্রথমে দর্শন করিয়াছে। তাই আনন্দ আনন্দ করিয়া, তাই সুখের আশায় আশান্বিত হইয়  জীব ছোটাছোটি করিয়া মরে। এই লীলা প্রদর্শন করাই জীবের একমাত্র ও মুখ্যতম উদ্দেশু।   এই মিলনানন্দেই_রসোপভোগ,–কিন্তু রস কয় প্রকার? রস প্রধানত গৌণ ও মুখ্যভেদে দ্বাদশ প্রকার। বীর, করুণ, অদ্ভুত, হাস্য, ভয়ানক, বীভৎস ও রৌদ্র, এই সাতটি গৌণ রস ; আর শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর, এই পাঁচটি মুখ্য রস। এখানে সাতটি গৌণরস, মুখ্য পঞ্চরসের পোষণকারী।


এখানে বলা হচ্ছে শ্রীবিষ্ণুকে শান্ত দাস্য ও সখ্যের অর্ধেক অর্থাৎ গৌরব সখ্য রসে সেবা করা হয়। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণকে পাচটি রসে সেবা করা হয়। এখানে বিষ্ণুকে যে সখ্য রসে সেবা করা হয়, সে সখ্যের মধ্যে মৃদু গৌরব বা সম্ভ্রম বিদ্যমান থাকে। ঠিক যেমনটা অফিসের কলিগদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। অন্যদিকে বিশ্রম্ভসখ্য রসে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা হয়। এ সখ্য হচ্ছে গভীরতম সখ্যতা যেমনটা ঘটে থাকে বাল্যবন্ধুদের ক্ষেত্রে।

৬ষ্ঠ পার্থক্য হচ্ছে  শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংরূপ মুল-দ্বীপস্বরূপ। তাহা হইতে অসংখ্য বিষ্ণুতত্ত্বরূপ দ্বীপ প্রজ্জ্বলিত বা প্রকাশিত হইয়াছে।


ব্রহ্মসংহিতার ৫ম অধ্যায়ের ৪৬নং শ্লোকে বলা হয়েছে-


এক মূল প্রদীপের জ্যোতি যেরূপ অন্য বাতি বা বাতিগত হয়ে বিবৃত হেতু সমান ধর্মের সঙ্গে পৃথক প্রজ্জ্বলিত হয়, সেরূপ বিষ্ণুতত্ত্বে যিনি প্রকাশ পান, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি। দর্শক, খেয়াল করবেন, শ্রীগোবিন্দ বা শ্রীকৃষ্ণকে এখানে আদি পুরুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যার থেকে বিষনুতত্ত্বরূপ দীপ প্রজ্জলিত হয়েছে।


৭ম পার্থক্য হচ্ছে কৃষ্ণ মাধুর্যবিগ্রহ আর বিষ্ণু ঐশ্বর্যবিগ্রহ। কৃষ্ণ পরমেশ্বর হইয়াও নিজেকে ইশ্বর মনে করেন না পরন্তু নিজেকে নন্দের পুত্র, রাধার নাথ প্রভৃতি বলিয়াই জানেন। কিন্তু বিষ্ণু ইশ্বর-অভিমানী।


এই পার্থক্যটি অনেকটা ২য় পার্থক্যের মতই। এখানে নতুন করে ইশ্বর অভিমানী কথাটা ব্যাবহার করা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখবেন, এই অভিমানী শব্দটি জাগতিক অভিমান বোঝায় না বরং বিষ্ণুর ঐশ্বরিক ভাবগাম্ভীর্য বা সম্ভ্রমভাবকেই বোঝানো হয়েছে।

৮মপার্থক্য হচ্ছে বিধিমার্গে বিষ্ণুসেবা আর রাগমার্গে কৃষ্ণ সেবা হয়ে থাকে।


অর্থাৎ, শ্রীবিষ্ণুকে সেবা করতে হলে আপনাকে বিধি মার্গ বা নিয়ম কানুনের রাস্তায় চলতে হবে। অন্যদিকে কৃষ্ণসেবা করার জন্য আপনি রাগ অনুরাগ বা ভালোবাসার রাস্তায় চলতে পারবেন।


৯ম এবং শেষ পার্থক্য হচ্ছে, বিষ্ণুসেবায় সম্ভম বুদ্ধি থাকায় সংকোচভাব আছে কিন্তু ব্রজবাসী ভক্তগনের কৃষ্ণসেবায় কোন সংকোচ নাই।


যেহেতু বিষ্ণু ইশ্বর অভিমানী এবং নিজের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখেন, তাই তার সেবায় ভক্তদের মধ্যে সংকোচ দেখা যেতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণ আমাদের সাথে এমন আপন হয়ে তার লীলা করেছেন যে, কৃষ্ণতে সমর্পিত হতে হলে আমাদের মধ্যে কোন সংকোচভাব তো থাকেই না উপরন্তু তাকে আমাদের একান্ত আপনজন বলে মনে হয়। তিনি আমাদেরই ব্রজের গোপাল, আমাদের রাধারানীর সখা, আমাদের গোপিনীদের প্রাননাথ আর আমাদের পরম মিত্র।





No comments

Theme images by sndrk. Powered by Blogger.